বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বর্তমানে অনলাইন ডেটিং অ্যাপ অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনলাইন ডেটিং অ্যাপ মূলত রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে তোলার একটা মাধ্যম। বাংলাদেশে সাধারণত প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি কিংবা অফিস থেকে। ফেইসবুক আর ইন্সটাগ্রামের মত সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর সেখান থেকেও অনেকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করেন মনের মানুষ। আর এই অনলাইন প্রেমের জগতে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপ।এই আপগুলো এই ধারণাই প্রচার করছে যে, এর মাধ্যমে পার্টনার খুঁজে পাওয়া নিশ্চিত।
আসুন, ডেটিং অ্যাপ নিয়ে আরও কিছু জেনে নেই।
ডেটিং অ্যাপ কিভাবে কাজ করে ?
ডেটিং অ্যাপ মেইনলি এক ধরণের মোবাইল অ্যাপলিকেশন / সফটওয়্যার যেখানে একজন মানুষ (ইউজার) তার নিজের ছবি এবং তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারে ফ্রি তে। এরপর ইউজারকে উল্লেখ করতে হয় তিনি কেমন ছেলে বা মেয়ে পছন্দ করেন (বয়স, হাইট, লোকেশন, ব্যাক্তিত্ব ইত্যাদি)। প্রাথমিকভাবে এসব তথ্য দেয়ার পর ডেটিং অ্যাপ একের পর এক সব প্রোফাইল দেখানো শুরু করে ইউজারকে। ইউজারের যেসব প্রোফাইল পছন্দ হয়, তাতে "লাইক" দেয়, এবং অপছন্দ হলে "ডিজলাইক" দেয়। ইউজার যাদের "লাইক" দিয়েছে বা পছন্দ করেছে, তারাও যদি পাল্টা ইউজারকে "লাইক" দেয়, তখন দুজনের মধ্যে "ম্যাচ" হয়। এরপর দুজন চ্যাটিং বা কথা বলার সুযোগ পায়। এভাবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ সামনে এগিয়ে যায় এবং সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
জনপ্রিয় ডেটিং অ্যাপ কোনগুলো
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, বেশ কয়েক ধরণের ডেটিং অ্যাপ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু অ্যাপ রয়েছে, যা ফ্রি তে ব্যবহার করা যায়। টিন্ডার, বাম্বল, ট্যানট্যান। বাংলাদেশ এবং পৃথিবীজুড়ে "টিন্ডার" এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাপ।
সবাই কি ডেটিং অ্যাপ ব্যাবহার করে ?
বাংলাদেশে ডেটিং অ্যাপ এর প্রচলন সেই ২০১৫ সালের দিকে। প্রথম দিকে হাজার খানেক মানুষে সীমাবদ্ধ থাকলেও এটা বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে। ইন্টারনেটের কল্যাণে এবং বিদেশী মুভিতে ডেটিং অ্যাপ এর ইউজ দেখে এর ধারনা সম্পর্কে দ্রুতই জেনে যায় বাংলাদেশের ইয়াং জেনারেশন। এছাড়াও বন্ধু বা কলিগদের মুখে শুনে প্রচুর মানুষ ডেটিং অ্যাপ এ জয়েন করে।
জার্মান ডেটা কোম্পানি ‘Statista’ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ডেটিং অ্যাপ ইউজারদের সংখ্যা ৪.৭% থেকে ৭.২% হতে পারে ২০২৩-২০২৭ সালের মধ্যে। ডেটিং অ্যাপ ব্যাবহার করা নিয়ে অনেকেই খোলামেলা কথা বলতে চান না। এ কারণে বাংলাদেশে আসলে কত মানুষ ডেটিং অ্যাপ ব্যাবহার করেন, তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না।
অনলাইন ডেটিং অ্যাপগুলো কি ধরনের প্রভাব ফেলছে ?
অনলাইন ডেটিং বাংলাদেশে প্রেমের ক্ষেত্রে "জোয়ার" এনেছে বললে ভুল হবেনা। রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মানুষ খোঁজার আগের যেকোন সিস্টেমের চেয়ে ডেটিং অ্যাপ তুলনামূলক অনেক সহজ। এখানে যারা আসছে, ধরেই নেয়া হয় তারা সিঙ্গেল, কাজেই কাউকে এপ্রোচ করতে আলাদা সংকোচ কাজ করেনা। আবার, তুলনামূলক প্রগ্রেসিভ চিন্তার ছেলে মেয়েরা ডেটিং এপ ইউজ করাতে মানসিকতার দিকে মিল পাওয়া সহজ হয়।
ডেটিং এপ এ একসাথে অনেক মানুষ থাকায় মনের মানুষ খোজা নিয়ে ইউজাররা কিছুটা চাপমুক্ত থাকেন। মোবাইল এপ্লিকেশন হওয়ায় যে কোন সময় যে কোন জায়গায় বসেই ডেটিং এপ ইউজ করা যায়। যারা ব্যস্ত লাইফস্টাইল লিড করছে তাদের জন্য এই অ্যাপগুলি পার্টনার খোঁজার প্রক্রিয়াটিকে সহজ করে দিচ্ছে।
ডেটিং অ্যাপ এর মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে এরকম অনেক উদাহারণ আমাদের চারপাশে তৈরি হচ্ছে। হয়তো সামনে একটা সময় আসবে যখন এটাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখা হবে। সেটা সমাজের নিয়ত পরিবর্তনশীল মানসিকতার উপর নির্ভর করে।
তবে ডেটিং অ্যাপ নিয়ে আমাদের সমাজে পসিটিভের চেয়ে নেগেটিভ ধারনাই বেশি। প্রথমত, ডেটিং এপ প্রেম-প্রত্যাশীদের চিন্তা অনেকদিক থেকে যেমন দূর করেছে, তেমন নতুন টেনশন ও যুক্ত করেছে অনেক। যেমন, ডেটিং অ্যাপ এ যেসব পার্সোনাল ইনফরমেশন দেয়া হয়, তার কতটুকু সত্যি আর কতটুকু বানানো, সেটা বোঝার কোন উপায় নেই। দেখা গেল, একজন ম্যারিড পুরুষ নিজেকে সিঙ্গেল দাবী করে বসেছে। আবার অনেকেই এমন ফিল্টার (সফটওয়্যার দিয়ে নিজেকে আরও সুন্দর করে প্রেজেন্ট করা) ইউজ করেন, যে ছবির মানুষকে দেখার পর বাস্তবের মানুষকে অন্য কেউ মনে হয় (!)
দ্বিতীয়ত, ডেটিং অ্যাপ এ মেয়েরা কিছুটা সিরিয়াসনেস নিয়ে ব্যাবহার করলেও বেশিরভাগ ছেলেদের আগ্রহ থাকে জাস্ট "টাইম পাস' করা। সিরিয়াস না হতে চাওয়া ছেলেরা আর মেয়েরা বাকিদের জন্য স্ট্রেস/টেনশন বাড়িয়ে দেয়, দিনের পর দিন দেখা সাক্ষাতের পর বিয়ের মত সিরিয়াস আলাপে না গিয়ে।
তৃতীয়ত, ৬-৭ বছর আগেও ডেটিং অ্যাপ মানেই ছিল সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত এবং মডার্ন ছেলে মেয়েদের প্ল্যাটফর্ম। সময়ের সাথে জনপ্রিয়তা বাড়ায়, স্বল্পশিক্ষিত মানুষেরাও এতে ঝুঁকে পড়েছে। কাজেই যারা আগে ডেটিং অ্যাপ ইউজ করতেন, তারা এখন আর আগের মত "পরিবেশ" পান না বলে অভিযোগ করেন।
চতুর্থত, ডেটিং অ্যাপ থেকে যারা বিয়ে করেন, তাদের অনেকে সামাজিকভাবে হেয় হবার ভয়ে প্রকাশ করেন না। দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজে সাধারণ প্রেমের বিয়ে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেলেও, ডেটিং অ্যাপ থেকে বিয়ে করাটাকে ইয়াং জেনারেশনের অনেকেও বাঁকা চোখে দেখেন, আর সিনিয়র সিটিজেনরা তো কল্পনাও (!) করতে পারেননা। এখানে একধরণের ভাবনা কাজ করে যে, "ও ডেটিং অ্যাপ থেকে বিয়ে করেছে, না জানি দুজনই কতজনের সাথে দেখা-পরিচয়ের পর এই বিয়েটা করলো !"
সবশেষ পয়েন্ট, ডেটিং অ্যাপ এসে প্রেমের সম্পর্ক কে আরও অনেক জটিল করে তুলেছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস, পরকীয়ার মত বিষয় ভালাবাসার মানুষদের মিথস্ক্রিয়ায় ঢুকে যাচ্ছে। প্রেম বা বিবাহিত জীবনে অশান্তি এলে আগেকার সময় মানুষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো সেটা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করার। ডেটিং অ্যাপ আসায়, অনেকেই "সাময়িক স্বান্তনা" খুঁজতে ডেটিং অ্যাপ ব্যাবহার করছেন, যা মূল সম্পর্ককেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
ডেটিং অ্যাপ এর ভবিষ্যৎ ?
ডেটিং অ্যাপ এর এতো নেগেটিভ দিক থাকার পরও সামনের দিনগুলিতে এর ব্যাবহার বেড়েই চলবে কারন হল এর সহজলভ্যতা এবং জনপ্রিয়তা। ইনফ্যাক্ট, আজকে থেকে ১০ বছর আগে হাতে গোনা কিছু ডেটিং অ্যাপ থাকলেও এখন অসংখ্য অ্যাপ তৈরি হয়েছে, যার অনেকগুলো আবার স্পেশাল সেগমেন্ট কে সার্ভ করে। যেমন- ডিভোর্সড মানুষদের কিংবা মধ্যবয়সীদের। অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখনকার সমাজ অনেক বেশি অনলাইন মিডিয়া নির্ভর এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের মাঝে অনেক অস্থিরতা। পাশাপাশি সাময়িক আনন্দের প্রতি মানুষের ঝোঁক। সবকিছু মিলে বলা যায়, খুব শীঘ্রই ডেটিং অ্যাপ আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেনা, বরং আরও বড় করাল গ্রাস নিয়ে আসতে যাচ্ছে হয়তো।
তরুণদের ক্ষেত্রে বাবা-মা এর ভূমিকা কি হতে পারে ?
ডেটিং অ্যাপের সাইড ইফেক্ট থাকবেই এবং এর জনপ্রিয়তাও বেড়েই চলবে। এর মধ্যেই যারা একান্তই ব্যাবহার করতে চান, তাদের উচিত হবে নিজের অনলাইন এবং তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ব্যাবহার করা। ডেটিং অ্যাপ থেকে কারো সাথে দেখা করার আগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বাবা-মা রা যারা চিন্তিত যে ছেলে মেয়ে কি আদৌ ডেটিং অ্যাপ ব্যাবহার করছে কিনা, তাদের উচিত হবে ছেলে মেয়ের সাথে বন্ধুর মত খোলামেলা আলোচনা করা। তাদের ভাবনা বুঝে তারপর নিজের ভাবনা তুলে ধরা। সাইয়োনিতে আমরা এমনও দেখেছি, অনেকেই বাবা মায়ের মাধ্যমে বিয়ের জন্য আগাচ্ছেন, আবার এদিকে ডেটিং অ্যাপ ব্যাবহার করছেন (যা আমরা পরে জেনেছি)। আমরা আশা করি, কোন বাবা মা ই চাইবেন না এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে।
লেখার কপিরাইট - সাইয়োনি
তথ্যসূত্র - দ্যা বিসনেস স্ট্যান্ডার্ড, প্রথম আলো, বিবিসি, ইত্তেফাক, সময় নিউজ
Comments